লিরিকাল মিরিক

খুব ছোটবেলায় একবার দার্জিলিং-সিকিম টুরে এসে মিরিক যাওয়া হয়েছিল আমার | সেবার আমরা প্রায় চল্লিশজন মিলে গ্রূপে বেড়াতে গিয়েছিলাম | এবার শিলিগুড়িতে থাকার সময় হঠাৎ করেই একদিন মিরিক প্ল্যান হলো | নাইট-স্টে নেই | দিনে দিনে ঘুরে আসব | নেট ঘেঁটে কিছুটা পড়াশোনা হল |কিছুটা এর-ওর কাছ থেকে খবর নেওয়া হলো | তো এক শনিবার ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়লাম | তেনজিঙ নোরগে বাসস্ট্যান্ডের পাশেই শিলিগুড়ি জংশন রেল স্টেশন | স্টেশনের সামনে থেকেই মিরিক যাওয়ার শেয়ারের গাড়ি ছাড়ে | কাউন্টার থেকে ১০০ টাকা করে টিকিট নেওয়া হল | খিদের চোটে পেটের ভেতর তখন রীতিমতো সুনামি এসে গেছে |  গাড়িটা ছাড়তে মিনিট পনেরো দেরি ছিল | আলু মটরের তরকারি দিয়ে গরম গরম ছটা লুচি ফটাফট উড়িয়ে দিলাম | শেয়ারের গাড়ি মানে ওই পাহাড়ে যাওয়ার জন্য যে মডিফায়েড বোলেরোগুলো থাকে, সেগুলো | আমাদের মাঝখানের সিটে বসার বন্দোবস্ত | সামনে বসা গেলনা | সেটা নাকি অলরেডি বুক করা | গাড়ি ছাড়ার একটু আগে এক জোড়া পায়রা এসে সেখানে বসে পড়ল | বুঝলাম এরাই আগে থেকে বুক করে রেখেছিলো | ছেলেটা বড় হাঁদা-ভোঁদা টাইপ | তুলনায় মেয়েটা বেশ স্মার্ট |

গাড়ি ছেড়ে দিল | একে মাঝের সিট তায় আমি আবার সবার মাঝখানে বসেছি | শিলিগুড়ি শহর ছেড়ে গাড়ি ঢুকে পড়ল দার্জিলিং মোড় হয়ে | এই রাস্তায় একটু এগোলেই শালবাড়ি | এই রাস্তার একটা মজা হল পাশে পাশে ছোট ট্রেনের লাইনটা চলে | এরপর সুকনা আরো সুন্দর | হাতি করিডোর ধরে গাড়ি এগোয় এখানে | হাতি হইতে সাবধান টাইপ বোর্ড দিয়ে রেখেছে বন দপ্তর | আমার তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই | বেরলে বেরবে | সুকনা মিলিটারি এরিয়া পেরিয়ে গেলাম | ডানদিকে চলে গেল রোহিণীর রাস্তা | ওই রাস্তায় দার্জিলিং গেলে সময় কম  লাগে কারন রোহিণীর রাস্তা খুব খাড়া হওয়ায় অল্প সময়ে অনেকটা উঠে যাওয়া যায় | রোহিণীর রাস্তায় ঢোকার উল্টো দিকে শিমুলবাড়ি টি এস্টেট | আমরা চা বাগানের এরিয়া ধরে মিরিকের দিকে এগোতে থাকলাম | সত্যি বলতে কি এই রাস্তাটা স্বর্গের থেকে কম কিছু না |  সবকিছুই যেন চা শিল্পের জন্য উৎসর্গ করা | একের পর এক চা বাগানের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে | সামনের কাঁচ দিয়ে যতটা দেখা যায় দেখছি |

সামনের সিটের পায়রা গুলো খুব মজায় আছে | তবে ছেলেটা খুব শান্ত |  মেয়েটা প্রায় জোর করেই যেন তাকে দিয়ে কথা বলাচ্ছে | মেয়েটাই সেলফি তুলছে | মেয়েটাই বকবক করছে | মেয়েটাই মাঝে মাঝে ছেলেটার কাঁধে মাথা রাখছে | ছেলেটা কেমন ম্যাদামারা হয়ে বসে আছে | আমার কেমন যেন রাগ হলো | এমন অসাধারন সবুজের উৎসব দেখলে তো সব মেয়েই উচ্ছল হবে | তুই ওকে একটু সাপোর্ট দে | এ কি রে | তার মধ্যে ছেলেটা আবার মাফলার পড়েছে | আরে একটা মেয়ের সাথে মিরিকে ডেটিংয়ে যাচ্ছিস, মাফলার পড়েছিস কেন রে ভাই ? খুব খারাপ লাগছিল মেয়েটার জন্য | তা যাই হোক, এসবের মধ্যে দিয়ে একসময় একটা ছোট জনপদে এসে পড়লাম | নাম দুধিয়া |IMG_4123_FotorIMG_4126_FotorIMG_4131_FotorIMG_4139_FotorIMG_4149_FotorIMG_4152_FotorIMG_4153_FotorIMG_4160_FotorIMG_4168_FotorIMG_4178_FotorIMG_4190_FotorIMG_4195_FotorIMG_4204_FotorIMG_4208_FotorIMG_4229_FotorIMG_4230_FotorIMG_4231_FotorIMG_4237_FotorIMG_4244_Fotor

বেশ নেপালি ঘেঁষা পুরনো জায়গা | প্রত্যেক বাড়ির সামনে ফুলের গাছ-ওয়ালা টাব | কিউটি-পাই নেপালি বাচ্চারা ঘুরে বেড়াচ্ছে এই সুইটি-পাই দুধিয়ায় | দুধিয়াতে বালাসন পেরলাম | বেশ এক্সপ্যান্ডেড নদী-খাত | তবে জল বেশি নেই | উপলে উপলে হিপ-হপ নাচতে নাচতে বালাসন চলেছে | এই নদীটাই সমতলে নেমে শিলিগুড়ির কাছে মাটিগাড়ায় এন এইচ ৩১এর নীচ দিয়ে বয়ে গেছে | বাগডোগরাতে বুড়ি বালাসন বলে একটা পুরনো খাত আছে | এই খাতে বালাসন আগে বইত | বুড়ি, মরা এইসব শব্দ নদীর নামের মধ্যে থাকলে বুঝতে হবে ওই খাতগুলো সে নদীর পুরনো খাত | পরবর্তীকালে নদী প্রবাহ পাল্টে অন্য খাতে বয়ে গেছে | বুড়ি বালাসনও তাই | মরা তোর্ষাও তাই | সেটা যদিও কোচবিহারে |

এই দুধিয়ার পাশে গোকুল বলে একটা দুর্দান্ত জায়গা আছে |  একটা রেস্ট হাউস আছে বলে শুনেছি | এই সার্কিটে একদম নিরালা স্পট বনকালাং | হোম-স্টে আছে | বনকালাং বালাসনের উপত্যকায় অসাধারন একটা ওয়ালপেপার | মূলতঃ গ্রাম, লোকজন খুব কম | নিরালা, নিস্তব্ধ | একটা পাতাঝরা ব্যাকগ্রাউন্ডে যেন একটা পাহাড়ি কলকলানো গান | বনকালাং এমনটাই | দুদিন কাটালে স্মৃতি হয়ে থাকবে | বউ নিয়ে যাওয়ার জায়গা নয় | এখানে এলে মিষ্টি প্রেমিকার সাহচর্য দরকার | গাছের গুঁড়িতে তাকে বসিয়ে গল্প কর | তার ঠান্ডা লাগলে জ্যাকেটের চেনটা টেনে দাও | হাঁটতে হাঁটতে তার পায়েল খুলে গেলে আবার পড়িয়ে দাও | নেপালিদের গ্রামে যদি প্রেমিকার সাথে একটু হাত ধরাধরি করে হাঁটা না হল তো প্রেম হবে কি করে | বউ এর সাথে প্রেম জমেনা, যতই বল | যেটা একটু হটকে, সেটাই প্রেম | মেয়েদের এখানে প্রেমিক নিয়ে আসা উচিত | বর নিয়ে নয় | সোজা কথায় বলতে গেলে প্রি-ম্যারেজ ওরিয়েন্টেশন ট্যুর বলে যদি কিছু হয় যেখানে হবু বড়-বউ নিজেদেরকে চিনতে পারে সেরকম ট্যুরের জন্য বনকালাং পারফেক্ট | তবে কাকা এগুলো গল্প কথা | আমাদের সমাজে এরকম জোটে কজনের |

দুধিয়ার পর থেকে কিন্তু পাক খেতে খেতে উপরে ওঠা | চা বাগান যে এত সুন্দর হয়ে পারে তার ধারণা আমার ছিলনা | এই পথে না গেলে সেটা বুঝতামনা | টি গার্ডেন বলে গুগল করলে যেরকম স্বপ্নমাখা চা বাগান এর ছবি বেরয় ঠিক সেরকম চা বাগিচা এখানে রয়েছে | শেয়ারের গাড়িতে যাওয়ার বিশেষ অসুবিধা হল যে গাড়িটা নিজের ইচ্ছেয় থামানো যায়না | তার মধ্যেই চলতে চলতে যেটুকু চা বাগানের মজা পেলাম সেটাও জীবনের বিরাট পাওনা | নিজের গাড়ি বা একটা ডেডিকেটেড ক্যাব এ গেলে মজাটা ব্যাপক হবে | আর তার সাথে পাওয়া যাবে এই অতুলনীয় প্রকৃতির স্পর্শ আর অনেক অনেক ছবি তোলার সুযোগ | বেশ কিছু চা বাগান খুব বড় বড় চা কোম্পানির মালিকানায় | বাগানগুলোর পাশে ফটকে লেখা আছে | বেশিরভাগ কোম্পানির হেড অফিস কলকাতায় | মাঝে মাঝে একটা করে জনপদ পেরিয়ে যাচ্ছে |কোনও কোনওটায় আমাদের গাড়ি দাঁড়াচ্ছে | কেউ নামছে বা উঠছে | প্রত্যেক জায়গায় নেপালিদের ছোট ছোট বাড়ি আর খাবারের দোকান | চাওমিন, মোমো, তাইপো এসব পাওয়া যাচ্ছে | চা, কফি তো আছেই | হোটেলগুলো কোনওটা গুরুঙ্গের, কোনওটা ছেত্রীর, কোনওটা রাইয়ের | প্রত্যেক জায়গায় দেখছিলাম কমলালেবু নিয়ে বসেছেন স্থানীয় মেয়েরা | তখন নভেম্বরের শেষ দিক | সবে মিরিকের কমলা বাজারে এসেছে |কমলা বাগানও অনেক দেখলাম | গাছে গাছে কমলা ঝুলছে | মিরিকের কমলার জগৎ-জোড়া খ্যাতি |

এভাবেই আস্তে আস্তে মিরিক গিয়ে ঢুকলাম | বেশ সাজানো গোছানো টাউন বলা যায় | নেপালিদের ব্যাপারে একটা সত্যি কথা বলতে পারি | ওরা সবসময় খুব ফিটফাট থাকে | কাউকে সাধারণতঃ অড ড্রেস-আপে দেখা যায়না | দারুন দারুন জিন্স, কর্ডস, জ্যাকেট আর সোয়েটারে চেহারা গুলো খুব সুন্দর লাগে | প্রথমেই ফেরার গাড়ির টিকিট কেটে নিলাম | এবার নিশ্চিন্তে ঘোরা যাবে | হিসেবে করে দেখা গেল হাতে প্রায় তিন ঘন্টা সময় আছে | মিরিক ঢোকার ঠিক আগেই আকাশের এক কোণে একটা সাদা সাদা ভাব দেখে মনে হয়েছিল যে ইনিই তিনি | কিন্তু মিরিকের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে উনাকে দেখতে পেলাম না | লেকের দিকে এগিয়ে গেলাম | সামেন্দু লেক কিন্তু ন্যাচারাল লেক নয় | মানুষের বানানো | জলটা একটু সবুজ সবুজ | তবে লেকটা সুন্দর | লেকে বোটিং করা যায় | ছোটবেলায় করেছি | এবার করার তেমন প্ল্যান ছিলনা | লেকের মাঝে একটা খুব সুন্দর ব্রিজ রয়েছে | আর লেকের পাশে বড়-সড় মাঠ | সেখানে প্রচুর লোক বসে আড্ডা মারছে | বাচ্চারা খেলছে, ছেলে-মেয়েরা প্রেম করছে | বেশ একটা ইকো-ফ্রেন্ডলি ব্যাপার | মাঠের পাশে রাস্তা আর রাস্তার ধার বরাবর খাবারের দোকান |

ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে গেলাম | ঘোড়া-ওয়ালাদের ভীড় | মিরিকে অনেকেই হর্স-রাইডিং করে | আমরা হেঁটে ডানদিকে একটু এগোতেই নীল আকাশের মধ্যে উনি দেখা দিলেন | কাঞ্চন সোনা | বরফে ঢাকা মূর্তিমতী দেবী যেন | এক লহমায় আমার মিরিক ভ্রমণটা পয়সা উসুল সিনেমা হয়ে গেল | বেশ কিছুটা দূরে উপরে একটা গুমফা মত দেখতে পেলাম | শুনলাম সেটা মিরিক মনাস্ট্রি | কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি হল | ফুলের ছবি তোলা হল | পাখি দেখা হল | ব্রিজ পেরিয়ে আবার এপারে চলে এলাম | এবার উঠতে হবে উপরে | এই অসামান্য মনাস্ট্রিটা দেখতে হবে তো |

হাঁটতে হাঁটতে একটা স্কুলে পৌঁছলাম | বেশ সুন্দর স্কুলটা | সামনে অনেক ফুলের গাছ | স্কুলের সামনে একটা লোককে মনাস্ট্রি যাওয়ার পথ জিজ্ঞেস করতে সে স্কুলের পাশের একটা রাস্তা দেখিয়ে সোজা উপরে উঠতে বলল | আমরাও একটু উপরে উঠে দেখলাম রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে | ডানদিকে উঠলে মনাস্ট্রি আর বাঁদিকে উঠলে ডন বসকো চার্চ | আমরা ডানদিক ধরলাম | একটা আশ্রমের পাশ দিয়ে উঠে বেশ খাড়া পাথরের সিঁড়িতে গিয়ে পৌঁছে আবার উঠতে লাগলাম | সিঁড়িটা একটা রাস্তায় এনে ছেড়ে দিল | সেই রাস্তা ধরে একটু উপরে উঠতেই দেখা গেল মনাস্ট্রিটা | রাস্তাটা ঘুরে ঘুরে উঠেছে | একটু এগিয়ে এক বিদেশিনীর সাথে দেখা | হাই-হেলো হল একটু | একটু পরে এসে ঢুকলাম মনাস্ট্রিতে | বোকার মনাস্ট্রি | অসাধারন সুন্দর | পরিষ্কার,পরিছন্ন | একটুও নোংরা নেই কোথাও | মনাস্ট্রির নীচে লামাদের শিক্ষা-কেন্দ্র |ছোট ছোট হবু লামারা তখন নিজেদের মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছে | মনাস্ট্রি থেকে মিরিক লেকটা দারুন ভাবে দেখা যায় | উপর থেকে দৃশ্যটা অসাধারন লাগে দেখতে | বেশ কিছু ছবি তুললাম | তারপর নেমে এলাম নীচে | চার্চে আর যাওয়া হলনা | পরে আমার একটা গল্পে অনেক দিন পর এই চার্চের কথা লিখেছি | আমি যেতে পারিনি তো কি হয়েছে, আমার গল্পের নায়িকা হৈমন্তীকে পাঠিয়েছি | এভাবেই আমার প্রায় সমস্ত ভ্রমণ ঢুকে পরে আমার গল্পে | চেনা-অচেনা রাস্তা আর অন্ধকার অলি-গলি গুলো মাথা তুলে উঠে দাঁড়ায় আমার গল্পগুলোয় | নীচে নেমে এসে লেকের পাশে একটা হোটেলে লাঞ্চ করলাম | দুই বোন মিলে চালায় দোকানটা | নাম সিস্টার্স ক্যাফে | নামটা খুব কার্যকর মনে হল | গরম মোমো আর থুকপা | বেশ ভালো রান্না করে | জমিয়ে খেয়ে চলে এলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে | যখন শিমুলবাড়ি চা বাগান পারছি তখন হাট প্রায় শেষ হয় হয় | গাড়িতে বসেই দেখতে হল | একদিন একটা ডেডিকেটেড ক্যাব নিয়ে আসার ইচ্ছে হল | যখন শালবাড়ি ঢুকলাম তখন হঠাৎ বাঁদিকে ছোট ট্রেনটা দস্যি বাচ্চার মত ভেঁপু বাজিয়ে পাশ দিয়ে পালিয়ে গেল | আমরাও ওর পেছন পেছন  চলতে থাকলাম শিলিগুড়ির  দিকে |


Leave a comment